ডেস্ক রিপোর্ট, ঢাকা: প্রাথমিক শিক্ষার অবকাঠামো উন্নয়নে ২৬ হাজার ৫১৭ কোটি ৯৪ লাখ টাকা ব্যয়ে পাঁচটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে এসব অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প থেকে ‘ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট ব্যয়’ বা ‘সার্ভিস চার্জ’ নামে ২ শতাংশ (পার্সেন্ট) হারে ৫১৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা নিয়েছে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)।‘ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট ব্যয়’ নাম দিয়ে এই অর্থ সংগ্রহ ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে কোনো আইন বা বিধিবিধান মানা হয়নি। এমনকি লঙ্ঘন করা হয়েছে সংবিধান। এ ধরনের অনিয়ম চালিয়ে যেতে প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত সরকারি দপ্তরগুলোকে এলজিইডির পক্ষ থেকে ৯৭টি গাড়ি উপহার দেওয়া হয়েছে। ফলে যেসব সংস্থা প্রকল্প অনুমোদন করে তারা সব জেনেও এ অনিয়মে বাধা দেয়নি। বিপুল পরিমাণ এ টাকা এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলীর নামে বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা রয়েছে। সংগৃহীত অর্থ কর্মচারীদের বেতন, আসবাব, জ¦ালানি ও যানবাহন রক্ষণাবেক্ষণ, বুথ অপারেশন, স্টেশনারি ক্রয় ও অন্যান্য খাতে ব্যয় দেখানো হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ও বলছে, এভাবে অর্থ আদায় ও খরচের আইনগত কোনো বৈধতা নেই। অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, শুধু প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পেই নয়, সরকারের আরও বেশ কয়েকটি সংস্থার কাজ করতে গিয়ে এলজিইডি এভাবে অর্থ নিয়েছে। যদিও প্রকৌশল কাজের সঙ্গে জড়িত সরকারের অন্য সংস্থা এ ধরনের কোনো অর্থ নেয় না। তবে এলজিইডির প্রকৌশলীদের দাবি, নিজেদের কাজের বাইরে অন্য সংস্থার কাজ করতে গেলে নানা কাজে অর্থ ব্যয় হয়। সে জন্য তারা ‘ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট ব্যয়’ হিসেবে ২ শতাংশ অর্থ নিয়ে থাকে। এমন প্রেক্ষাপটে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। গত ৬ জুলাই স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে উপসচিব জেসমিন পারভীন একটি চিঠি দিয়ে এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলীকে ম্যানেজমেন্ট সাপোর্টের নামে চলতি বছরের এখন পর্যন্ত নেওয়া টাকার মধ্যে অব্যয়িত ২৯ কোটি ২২ লাখ ১৮ হাজার ৮৩৬ টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত দিতে বলেন। ২০০৪ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত শুধু প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে ২৬ হাজার ৫১৭ কোটি ৯৪ লাখ টাকার কাজ চলছে। ৫টি প্রকল্পের মধ্যে ‘চাহিদাভিত্তিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে (১ম পর্যায়)’ ৭ হাজার ৭২ কোটি টাকার মধ্যে ১৩৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা ‘ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট ব্যয়’ নামে খরচ দেখানো হয়েছে। একইভাবে ‘চাহিদাভিত্তিক নতুন জাতীয়করণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে (১ম পর্যায়)’ ৪ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকার মধ্যে ৮৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকা, ‘চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (পিইডিপি-৪)’ ১৩ হাজার ৩৬১ কোটি ৫০ লাখ টাকার মধ্যে ২৬৭ কোটি ৫৩ লাখ টাকা, ‘ঢাকা মহানগর ও পূর্বাচলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন, অবকাঠামো উন্নয়নসহ দৃষ্টিনন্দনকরণ প্রকল্পে’ ১ হাজার ৬১৭ কোটি ৪১ লাখ টাকার মধ্যে ২১ কোটি ৩২ লাখ ৯৫ হাজার টাকা ও ‘রিচিং আউট অব স্কুল চিলড্রেন প্রকল্পে (২য় পর্যায়)’ ২০ কোটি ৬৬ লাখ টাকার মধ্যে ৫০ লাখ টাকা ‘ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট ব্যয়’ নামে খরচ দেখানো হয়েছে। সব মিলিয়ে শুধু এ খাতে ৫১৪ কোটি ৩১ লাখ ৫৩ হাজার টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। এসব প্রকল্পের আওতায় প্রাথমিক বিদ্যালয় ও অন্যান প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো নির্মাণ, সম্প্রসারণ, সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ এবং বড় ধরনের মেরামতকাজ করা হয়েছে। আবার কোথাও কোথাও চলমান রয়েছে। এখানে ‘ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট ব্যয়’ নামে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ যেসব খাতে খরচ দেখানো হয়েছে, তা বাস্তবসম্মত নয়। অর্থ বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একটি প্রকল্পে সব ধরনের ব্যয় ধরার পরও কেন ২ শতাংশ টাকা ‘ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট ব্যয়’ নামে খরচ দেখানো হয়েছে তা নিয়ে অর্থ বিভাগের বিদায়ী সচিব ও বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার আপত্তি দেন। এরপর বিষয়টি নিয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত সিদ্ধান্তের জন্য নথি পাঠানো হলে তা গত বছরের ২০ জানুয়ারি অনুমোদন হয়। সব পর্যায়ে সিদ্ধান্তের পর গত বছরের ২৮ জানুযারি অর্থ বিভাগ থেকে একটি অফিস আদেশ জারি করা হয়। সেই আদেশে বলা হয়, ২০১৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) সভায় এলজিইডির ‘ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট ব্যয়’ ২ শতাংশের বিষয়ে বিশেষ নিরীক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দেন। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী অর্থ সচিব মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রককে একটি আধা সরকারি পত্র (ডিও) দেন। সেখানে তিনি এলজিইডি একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান উল্লেখ করে বলেন, সমুদয় আবর্তক ব্যয় পরিচালনা বাজেটের আওতায় এলজিইডির অনুকূলে বরাদ্দ দেওয়া হয়। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের সংবিধান এবং সরকারি অর্থ ও বাজেট ব্যবস্থাপনা আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ২ শতাংশ ‘ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট ব্যয়’ আদায় এবং কোন কোন খাতে তা ব্যয় করা হয়েছে তা খতিয়ে দেখতে একটি বিশেষ নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অনুরোধ করেন অর্থ সচিব। এরপর নিরীক্ষা কর্তৃপক্ষ তদন্ত করে তাদের প্রতিবেদনে জানায়, ২০০৪-০৫ অর্থবছর থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত ভ্যাট ও আয়কর বাদে এ খাতে সংগৃহীত অর্থের পরিমাণ ৪৪৫ কোটি ১৩ লাখ টাকা। এ অর্থ থেকে ব্যয় করা হয়েছে ৪২২ কোটি ৭২ লাখ টাকা। অব্যয়িত রয়েছে ২২ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। ‘সংযুক্ত তহবিল ও প্রজাতন্ত্রের সরকারি হিসাব’ সম্পর্কিত সংবিধানের ৮৪(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সরকারের সকল রাজস্ব, সকল ঋণ এবং ঋণ পরিশোধ পর্যন্ত সব অর্থ একটি মাত্র তহবিলের অংশে পরিণত হবে এবং তা সংযুক্ত তহবিল নামে অভিহিত হবে। আর সংবিধানের ৯০(৩) অনুচ্ছেদে বলা আছে, এই অনুচ্ছেদের বিধানাবলী অনুযায়ী গৃহীত আইনের দ্বারা নির্দিষ্টকরণ ব্যতীত সংযুক্ত তহবিল থেকে কোনো অর্থ প্রত্যাহার করা যাবে না। এ ছাড়া ‘ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট ব্যয়’ নামে টাকা সংগ্রহ ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে মানা হয়নি সরকারি অর্থ ও বাজেট ব্যবস্থাপনা আইন ২০০৯-এর (৭১) বিধান। ওই বিধান অনুযায়ী, সব প্রাপ্তি সংযুক্ত তহবিলে জমা করতে হবে। এলজিইডি একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান বিধায় তাদের ব্যয় নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বাজেট বরাদ্দের মাধ্যমে দেওয়া হয় এবং আইন অনুযায়ী তাদের সমুদয় অর্থ জমা করার কথা সংযুক্ত তহবিলে। সেই অনুযায়ী এলজিইডির আদায় করা ২ শতাংশ অর্থও একই সংযুক্ত তহবিলে জমা করতে হবে। জাতীয় সংসদের অনুমোদন এবং আইনের আওতায় কোনো তহবিল গঠন ব্যতিরেকে এ রকম ‘ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট ব্যয়’ বা ‘সার্ভিস চার্জ’ হিসেবে সংগৃহীত অর্থ ব্যয় করা বা এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলীর নামে বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে জমা রাখার আইনগত ভিত্তি নেই। নিরীক্ষা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ‘ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট ব্যয়’ নামে অর্থ আদায় ও তা ব্যয়ের বিষয়ে গত বছরের ২০ জানুয়ারি তিনটি সিদ্ধান্ত চূড়ান্তভাবে অনুমোদন করে অর্থ মন্ত্রণালয়। এরপর জরুরিভাবে একই মাসের ২৮ তারিখে তিনটি সিদ্ধান্ত জানিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের চিঠি দেওয়া হয়। সেখানে নিয়মবহির্ভূতভাবে ‘ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট ব্যয়’ বাবদ অর্থ আদায় এবং তা ব্যয় করার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে স্থানীয় সরকার বিভাগকে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ‘ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট ব্যয়’ গৃহীত অর্থের অব্যয়িত ২২ কোটি ৯৭ লাখ টাকা অবিলম্বে চালানের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে জমা করার জন্য এলজিইডিকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। এ ছাড়া এলজিইডির দৈনন্দিন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য অর্থের প্রয়োজন হলে পরিচালন বাজেটের আওতায় বরাদ্দ দাবি করা যেতে পারে এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন হতে এ ধরনের অর্থ সংগৃহীত হলে তা অবিলম্বে সংযুক্ত তহবিলে জমা দিতে হবে বলে জানানো হয়। তবে এসব সিদ্ধান্ত এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি। এলজিইডির একজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বলেন, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের অর্পিত দায়িত্ব ছাড়া যেসব সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাজ করবে, সেখানে ২ শতাংশ ‘ম্যানেজম্যান্ট সাপোর্ট ব্যয়’ দিতে হবে। এটা না দিলে এলজিইডির কাজ করা সম্ভব হবে না। কেননা নির্ধারিত কাজের বাইরে তাদের বাড়তি কাজের জন্য কোনো ধরনের সহায়তা দেওয়া হয় না। তাই ‘ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট ব্যয়’ হিসেবে নেওয়া অর্থ দিয়েই কাজ করার জন্য সব ধরনের সহায়তা নেওয়া হয়। তিনি বলেন, এলজিইডি তাদের দায়িত্বের বাইরে গিয়ে কাজ করতে খুব বেশি আগ্রহী না। যেসব সংস্থা এলজিইডিকে দিয়ে কাজ করাবে, তাদের ২ শতাংশ দিতে হবে।